Header Border

ঢাকা, শনিবার, ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল) ১৩.৬৯°সে

পুঁজিবাজার ছেড়ে যাচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা

বিদেশী বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করেই স্থানীয় বা আঞ্চলিক পুঁজিবাজার বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। একটি দেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগের জন্য কতটা উপযুক্ত সেটিও বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। যদিও দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ চার বছরের বেশি সময় ধরে ক্রমেই কমছে। এর মধ্যে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ তারা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছেন বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি কমে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আরো কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারে।

পুঁজিবাজারে ক্রমেই বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা। এমএসসিআই ফ্রন্টিয়ার মার্কেট সূচকের রিটার্ন ১০ বছর ধরেই শ্লথ অবস্থানে রয়েছে। ফলে ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে বিদেশীরা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন। এর বিপরীতে ২০০৮ সালের সাব-প্রাইম মর্টগেজ সংকটের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা যাচ্ছে। এ কারণে বেশি রিটার্নের আশায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, তারল্য ঝুঁকি, মুদ্রা বিনিময় হার ঝুঁকির বিষয়গুলোও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ ১০ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণেও এ খাতের বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আদালতের দ্বারস্থ হতেও দেখা গেছে তাদের। কভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালের মার্চে শেয়ার নির্দিষ্ট দরের নিচে যাতে কমতে না পারে সেজন্য ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তখন অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী ক্রেতা না থাকার কারণে শেয়ার বিক্রি করতে চেয়েও করতে পারেননি। ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়টিকেও মুদ্রাবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিদেশীরা। বৈশ্বিকভাবেই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয় বিদেশীদের কাছে। সর্বোপরি সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টিও বিদেশীদের এ দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের অন্যতম একটি কারণ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালম মো. মনিরুজ্জামান  বলেন, ১০ বছর ধরেই এমএসসিআইয়ের ফ্রন্টিয়ার মার্কেট ইনডেক্স সেভাবে পারফর্ম করছে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সাব-প্রাইম সংকটের পর থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাচ্ছেন। ফ্লোর প্রাইস আরোপ, সুদহার নির্ধারণের মতো বিষয়গুলোকে বিদেশী অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া তারল্য ঝুঁকি ও সাম্প্রতিক সময়ে টাকার অবমূল্যায়নের ঝুঁকির বিষয়টি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে এসব কারণেই বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ক্রমেই কমছে। বিদেশীদের বিনিয়োগ হাতে গোনা কিছু বড় মূলধনি ভালো কোম্পানিতে সীমাবদ্ধ। ফলে তারা যখন এসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করছেন তখন পুঁজিবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর পরের দুই বছর ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৭ কোটি ৯০ লাখ ও ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। ২০১৭ সালে এটি বেড়ে ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। অবশ্য এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে নিম্নগামী অবস্থানে রয়েছে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রবণতাই বেশি দেখা যাচ্ছে বিদেশীদের মধ্যে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে সুযোগ কমে গেছে বলেই বিদেশীরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ঘন ঘন আইন-কানুন পরিবর্তন করাটা বিদেশীদের অপছন্দ। প্রথমে কভিডের কারণে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হলো এবং কিছুদিন পর বাজার বন্ধ করে দেয়া হলো। এখন আবার সার্কিট ব্রেকারের নিম্নসীমা ২ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের হস্তক্ষেপের ফলে বাজারে শেয়ারের ক্রেতা কমে যায়। তখন চাইলেও শেয়ার বিক্রি করা যায় না। বিশ্বের কোথাও পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের হস্তক্ষেপের উদাহরণ রয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ কারণে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে প্রয়োজনের সময় সেটি ফেরত নিতে পারবেন কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা কাজ করে বিদেশীদের মধ্যে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, বেশকিছু ভালো কোম্পানির আয় বাড়ার পাশাপাশি শেয়ারদর যৌক্তিক পর্যায়ে থাকলেও বিদেশীরা কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না। পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক দরপতনের পেছনে বিদেশীদের শেয়ার বিক্রিও অন্যতম একটি কারণ। দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হবে।

দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছে বিএসইসি। এজন্য গত এক বছরে সংযুক্ত আরব-আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে রোড শো আয়োজন করেছে সংস্থাটি। সামনে বিনিয়োগ আকর্ষণে কাতার ও সৌদি আরবে রোড শো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যাতে সহজেই নিটা অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক হিসাব ও বিও হিসাব খুলতে পারেন, সেজন্যও উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বিদেশীরা শেয়ার কেনা-বেচার মধ্যেই থাকেন। গত দুই বছরে পুঁজিবাজারের সূচক ৩ হাজার ৬০০ থেকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশীরা শেয়ার বিক্রি করে মূলধনি মুনাফা তুলে নিয়েছেন। তবে বর্তমানে পুঁজিবাজারে দর সংশোধন হওয়ার কারণে বিদেশীদের মধ্যে শেয়ার কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের মত পর্যাপ্ত সংখ্যক শেয়ারের স্বল্পতা রয়েছে। ফলে হাতেগোনা কিছু কোম্পানি ও খাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে বিদেশীদের বিনিয়োগ। দেশের পুঁজিবাজারের ১৯টি খাতের কোম্পানিতে বিদেশীদের কৌশলগত ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর শেষে বিদেশীদের কাছে থাকা ওষুধ খাতের শেয়ারের বাজার মূলধন ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপর সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ব্যাংক, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক, টেলিযোগাযোগ, প্রকৌশল, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বস্ত্র, বিবিধ এবং বীমা খাতে। এছাড়া সিমেন্ট, তথ্য-প্রযুক্তি, সেবা ও আবাসন, মিউচুয়াল ফান্ড, চামড়া, সিরামিকস এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানিগুলোতে কিছু বিদেশী বিনিয়োগ ছিল।

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

সাত ব্যাংকেই ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ সালমান এফ রহমানের
এ বছর বেশি শীত অনুভূত হওয়ার কারণ কী ?
শাহজালালে ৮ কেজি স্বর্ণসহ এয়ারক্রাফট মেকানিক আটক
‘অনৈতিক’ প্রস্তাবের অভিযোগ নায়িকার, আব্দুল্লাহ জহির বাবুর অস্বীকার
অনেক পরিচালক আমাকে হোটেল-রেস্টুরেন্টে ডাকে : জেবা
আফগানিস্তানের বিপক্ষে কঠিন সময় আসছে: পাপন

আরও খবর